রাজা প্রিয়াম এর হুকুম পছন্দ না হলেও সংখ্যা গরিষ্ঠ রাজ্য প্রধানদের সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে যুদ্ধ করতে রাজি হয় ছেলে সেনাপতি, হেকটর। যুদ্ধ নীতি তৈয়াক্কা না করে রাজ্যের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাতের গভীরে করল প্রতিপক্ষকে আক্রমন। অনিচ্ছার এ যুদ্ধে শেষমেশ টার্গেট করল প্রতিপক্ষ সেনাপ্রধান, আঁকিলিস কে। অন্যদিকে নিজ রাজার সাথে অভিমানে আঁকিলিস সিদ্ধান্ত নিলো এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার। শেষ পর্যন্ত তাই হলো।
স্বয়ং আঁকিলিস থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া তার ছোটা চাচাতো ভাই আঁকিলিস কে বারবার যুদ্ধে যাবার অনুরোধ করেও সাড়া না পেয়ে শেষে একা যুদ্ধ যাবার সিদ্ধান্ত নিলো। রাতের গহীনে অসংখ্য যোদ্ধাকে পরাহত করে হেকটর এর সামনে এবার পড়লো আঁকিলিস এর ছোট চাচাতো ভাই। আপন চাচাতো ভাইয়ের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ দেশের পক্ষে যুদ্ধ করল অনেকটা আঁকিলিস এর মত। আঁকিলিস এর যুদ্ধের সাজসজ্জা পরিহিত ছোট চাচাতো ভাই এর রণ কৌশল দেখে, সবাই ভাবলো এ বুঝি আঁকিলিস!
যুদ্ধ চলছে অনেকক্ষণ। হেকটর আর নকল আঁকিলিস এর সাথে। এ যুদ্ধের এক পর্যায়ে আঁকিলিস এর ছোট্ট আদুরে চাচাতো ভাইটি হেকটর এর রণ কৌশলে, ছোবলে তীর বিধে যায় বুকে, মাটিতে লুটে পড়ে। মাথার হেলমেট খুলতেই দেখা গেলো এটা ছিল আঁকিলিস এর চাচাতো ভাই। সঙ্গে থাকা সকলে বলে উঠল, "It was his cousin"। অনেকক্ষণ যুদ্ধ করে ক্লান্ত হেকটর মুহূর্তে চেহেরা মলিন করে ফেলল। আর মনে মনে বলতে লাগলো, এটা বড্ড ভুল হয়েছে। একটা নিষ্পাপ ছেলেকে হত্যা করা হলো। এর ফল অচিরেই আমাকে পেতে হবে।
বিচক্ষণ হেকটর বুঝতে পারল, তার দিনও ফুরিয়ে আসছে। কারণ সে অনেক ছোট্ট নিষ্পাপ একজনকে আঁকিলিস ভেবে পরাজিত করে হত্যা করেছে। বাড়ীতে গিয়ে বউকে বলল, "Today I killed a soldier, he was young, too young"। আত্নতত্ত্ব তার জ্ঞান খুলে দিয়েছে। আসলে যুূদ্ধেও রয়েছে কতকগুলো নিয়মকানুন, নীতি-নৈতিকতা। এটাকে যুদ্ধ আইন / মানবিক আইন / Humanitarian Law বলে। যোদ্ধাদের এ ল' মেনে চলতে হয়। নিরস্ত্র কারো উপর কতটুকু শক্তি প্রয়োগ করা যাবে, তার ধারণা রয়েছে এ আইনে।
বড়ো আদরের ছোট চাচাতো ভাই এর মৃত্যুতে একবারে রেগে-মেগে আগুন আঁকিলিস। যুদ্ধে না যাবার সিদ্ধান্ত মুহূর্তে পাল্টে সিদ্ধান্ত নেয় একা প্রতিশোধ নেবার। চলে আসে হেকটর এর সুরক্ষিত আস্তানায়। একা আগত রণবীর আঁকিলিস এর সাহস যেনো হেকটর কে একেবারে ক্ষীণ করে দিলো। উপরের সীমান্ত দেয়াল সুউচ্চ প্রাচীরে অবস্থানরত অধস্তন সৈনিকরা আঁকিলিস কে তীর নিক্ষেপ করতে চাইলে হেকটর বারণ করে। তৈরি হয় একা যুদ্ধ করতে। কারণ একা যুদ্ধ লড়তে আসা প্রতিপক্ষের সাথে একা লড়তে হয়, এটাই যুদ্ধের নৈতিকতা, আর তা হেকটর ভালো করে জানতেন। একা লড়াই করতে করতে এ যুূদ্ধে হেকটর হেরে যান, তার অনির্বাণ শিখা চিরতরে নিভে যায় নিষ্পাপ ছোটকে মারার পাপে।
আজ এ দেশে একটা বড়ো হাহাকার বিরাজমান, দেশের অধিকাংশ মানুষ শোকে মূহ্যমান। মাতম চলছে ঘরে ঘরে। শিক্ষার্থীদের একটা যৌক্তিক দাবীর আন্দোলন শেষমেশ কোথায় গিয়ে ঠেকলো, সমাধান হলো কতগুলো প্রাণের বিনিময়ে, কত স্থাপনা ধ্বংসের পরে। কতগুলো নিষ্পাপ, নিরিহ প্রান ঝড়ে গেলো চিরতরে। এমন যৌক্তিক আন্দোলনকে কেনো শুরুতেই, অল্পতে শেষ করা গেলো না। সমাঝোতার শেষের কথাগুলো কেনো কোনো প্রান ঝরার আগে এলো না, হলো না।
এ সন্তানগুলো সবাই এ দেশের সন্তান, এ দেশের নাগরিক। কোটা আন্দোলনে কোনো নির্দিষ্ট দলের শিক্ষার্থী শুধু ছিল এমনও নয়। একটা নিষ্পাপ আন্দোলন, মেধাকে স্হান দেয়ার আন্দোলন শুধু। এতগুলো নিষ্পাপ প্রাণ কেড়ে নেয়া মানুষেরা হয়তো অচিরেই বুঝবে হেকটর এর মত যে নিষ্পাপ সন্তানদের সাথে এতোটা কঠোর হওয়া উচিত হয়নি। উচিত হয়নি তাদের আন্দোলনকে প্রলম্বিত হতে সুযোগ দেয়া। নিষ্পাপ প্রান যে করেছে হরণ, বুঝবে অচিরেই তার কৃতকর্মার উদারণ। নিজের দোষ-গুন যে জেনেছে, প্রকৃত জ্ঞানী সে হয়েছে।
লেখক- সাজজাদুল ইসলাম রিপন
এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি (বি.আই.ইউ) এ সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন।